ইসলাম ও স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ক কী?
ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এটি দ্বীনুল ফিতরাহ। ইসলাম মানবপ্রকৃতির সাথে, জীবনের বাস্তবতা ও চাহিদাগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহর এই দ্বীন সমগ্র মানবজাতির জন্য। তাই ইসলামের মধ্যে আছে প্রশস্থতা। মহান আল্লাহ আমাদের একটা মৌলিক কাঠামো দিয়েছেন, কিছু নির্দিষ্ট প্যারামিটার আর সীমানা ঠিক করে দিয়েছেন। এগুলোকে অক্ষত রেখে বৈচিত্র্যের সুযোগ ইসলামে আছে।
ইসলাম এক অঞ্চলের মানুষকে অন্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস বা সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণ করতে বলে না। আরবরা খাবারে খুব কম মশলা ব্যবহার করে। মশলা ছাড়া খাবার আবার আমাদের কাছে লাগে পানসে। ইসলাম বাংলার মানুষকে বলে না, আরবের মানুষের খাবার খেতে। আফ্রিকার মানুষকে বলে না পারস্যের মানুষের ভাষায় কথা বলতে।
কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলামী ইলমের ভাষা হবার কারণে আরবীর বিশেষ মর্যাদা আছে, কিন্তু কোন ভাষাকে ইসলাম সত্তাগতভাবে নাকচ করে না। বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে নাকচ করার প্রবণতা পাকিস্তানের সেক্যুলার শাসকগোষ্ঠী আর এলিটদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা, এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব কিছু আচরণ এবং বৈশিষ্ট্য থাকে। শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক না হলে, ইসলাম সেগুলোকে বাদ দিতে বলে না।
একারণেই মুসলিম জাতির ইতিহাসে বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্য দেখা যায়। একেক অঞ্চলের মানুষের খাবার আলাদা। পাগড়ী বা কুফি পরার রীতি আলাদা। পার্থক্য আছে টুপির স্টাইলে, এবং পোশাকেও। আরবদের জুব্বা আর উপমহাদেশের সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা, কুর্দিদের সালওয়ার আর পাঠানদের সালওয়ার একরকম না।
একেক অঞ্চলের নারীরা জিলবাবের ক্ষেত্রে একেক ধরণের রং পছন্দ করেন। আরবে সাধারণত কালো রং বেশি ব্যবহার হয়, আফ্রিকার দিকে নেভি ব্লু, মেরুন ইত্যাদি রঙের ব্যবহার বেশি। আর্কিটেকচার, ক্যালিগ্রাফির মতো বিষয়েও এলাকা ভেদে পার্থক্য হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়াহর শর্তগুলো মানা হচ্ছে ততোক্ষণ এ ধরণের বৈচিত্র্যে কোন সমস্যা নেই। তবে অবশ্যই সুন্নাহর অনুসরণ প্রশংসিত, উত্তম এবং অধিক কাম্য।
সমস্যা দেখা দেয়, যখন সংস্কৃতিকে ইসলামের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অর্থাৎ, ইসলামের কোন স্পষ্ট বিধানকে ‘আরবীয় সংস্কৃতি’ বলে নাকচ করা, অথবা দেশীয় সংস্কৃতির নামে ইসলামের কোন বিধানের বিরোধিতা করা।
দিন কয়েক আগে কেনিয়ার এক ফেমিনিস্ট সুশীলের কলাম পড়ছিলাম। দেখলাম হিজাব এবং জুব্বার বিরুদ্ধে তার কথা আর বাঙ্গাল সেক্যুলারদের কথার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। সেই একই যুক্তি – আমিও তো মুসলিম। কিন্তু মুসলিম হতে হলে আরবদের মতো কেন হতে হবে? নিজেকে কেন মরুভূমির মানুষের মতো ঢেকে রাখতে হবে? কেন আমাদের সংস্কৃতি আমাদের পোশাক বিসর্জন দিতে হবে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইসলামি বিধিবিধানের বিরুদ্ধে এধরণের আপত্তি তোলা লোকদের মূল বক্তব্যটা সহজ: ইসলামের যে বিষয়গুলো আমাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং পশ্চিমা-লিবারেল ভ্যালুর সাথে মিলবে, সেগুলো আমরা গ্রহণ করবো। বাকিগুলো বাদ দেবো।
ইসলামের অবস্থান উল্টো: দেশীয় সংস্কৃতির যা কিছু ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না, সেগুলো আমরা গ্রহণ করতে পারি। যা কিছু সাংঘর্ষিক এবং/অথবা ক। ]ফি]রদের অনুকরণের অন্তর্ভুক্ত সেগুলো আমরা বাদ দেবো।
অর্থাৎ মৌলিক পার্থক্যটা মাপকাঠিতে। বাঙ্গালি, বাঙ্গালিয়ানা, মুসলিম পরিচয় নিয়ে পুরো তর্কের মূল কেন্দ্র এখানে। মুসলিমদের অবস্থান হল চূড়ান্ত হিসেব হবে ইসলামের ভিত্তিতে। সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, কিংবা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে ইসলাম সিদ্ধান্ত দেবে। ইসলাম এই অঙ্গনগুলোকে সংজ্ঞায়িত করবে। কিন্তু এগুলো ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না। কারণ এই দ্বীন রাব্বুল আলামীন নাযিল করেছেন পরিপূর্ণ হিসেবে। মুসলিমদের মূল মাপকাঠি হল ইসলাম। এই মাপকাঠির ভিত্তিতে আমরা গ্রহণ বা বর্জন করবো। সেক্যুলারদের মূল মাপকাঠি ভিন্ন কিছু।
কেউ যদি এই সহজ পয়েন্টটা ধরতে পারে, তাহলে মিতা হকদের বাঙ্গালিয়ানা, ফরহাদ মজহাদের আরব-ইরান-তুরানের ইসলাম বাদ দিয়ে দেশীয় ইসলামের বুলি, কিংবা ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ মডারেট সেক্যুলারদের ইসলামকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টার বাস্তবতা বোঝা খুব সহজ হয়ে যায়।
সেক্যুলারদের বিভিন্ন ঘরানার মূল বক্তব্য হল: ইসলামকে তাদের পছন্দের মূল্যবোধের আলোকে কাটছাট ও ব্যাখ্যা করা। এ জায়গাতে তারা সবাই এক। তারা কেউ ইসলামকে মূল মাপকাঠি, সেন্ট্রাল ডোমেইন হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি না। তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কেবল এতোটুকুই যে এদের মধ্যে কেউ কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙ্গালিয়ানাকে মাপকাঠি মনে করে, কেউ নদীয়াকে, কেউ পশ্চিমের ক্লাসিকাল লিবারেলিসমকে।
আর এসব মাপকাঠির আলোকে তারা দাবি করে, আমাদের; অর্থাৎ প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের নিজেদের বাঙ্গালিত্ব, কিংবা দেশীয় আইডেন্টিটির প্রমান দিতে হবে। যেন আমরা সার্কাসের বানর, নানা কসরত করে, রিং এর ভেতরে দিয়ে লাফিয়ে, দড়ি ধরে ঝুলে নিজেদেরকে প্রমাণ করতে হবে। যেন আমরা এ মাটিতে বানের জলে ভেসে আসছি, এলাকার সর্দারদের কাছে আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে এখন ভিক্ষা চাইতে হবে।
চিন্তার এই পুরো ফ্রেইমওয়ার্কটাই আমরা প্রত্যাখ্যান করি। আমরা এই মাটির মানুষ, আমাদের পরিবারগুলো শত শত বছর ধরে এখানে আছে। আমরা এ ভাষায় কথা বলি, আমরা সমাজের অংশ। আমরা সমাজ ও সমাজের মানুষের জন্য কাজ করি। আমাদের কেন এদের কাছে নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রমাণ দিতে হবে? আর এগুলো না থাকলেও আমাদের কোন প্রমাণ দিতে হতো না। এই যমীনের মালিক আমাদের অধিকার দিয়েছেন, বাকি কারো কথা তাঁর কথার ওপরে যায় না।
তাই আমাদের কী দায় পড়েছে সেক্যুলারদের খেয়ালখুশিমতো ঠিক করা মাপকাঠি অনুযায়ী নিজের পরিচয় আর দ্বীন বিকৃত করার? আমার কি দায়, তাদের হীনমন্যতাকে জাস্টিফাই করার জন্য ‘বাঙ্গালি ইসলাম’ তৈরি করার? ইসলামকে ভালোবাসা মানুষদের মধ্যে যারা না বুঝে এই ফ্রেইমওয়ার্ককে গ্রহণ করে নিয়েছেন, তারা বড় ধরণের ভুল করছেন। এই লাইনে চিন্তা আপনাদের গ্রহণযোগ্যতা দেবে না, দীর্ঘমেয়াদে আপনাদের সেক্যুলারদের ‘ইউসফুল ইডিয়ট’ বানাবে।
এই দ্বীন যেমন আমার, এই যমিনও আমার। কারও খেয়ালখুশি মতো আমরা আমাদের দ্বীনকে বদলাবো না। কোন জমিদারের আদেশ মতো নিজেদের ‘বাঙ্গালি’ প্রমাণে আমরা বাধ্য নই।
সেক্যুলারদের যদি ইসলাম নিয়ে এতোই সমস্যা হয়, তাহলে তারা ইনিয়েবিনিয়ে কথা না পেঁচিয়ে সরাসরি বলে ফেলুক: অমুক অমুক ক্রাইটেরিয়া মতো না হলে আমরা ইসলাম ধর্মকে মেনে নিতে পারবো না। ইসলামের অমুক অমুক বিধান বাদ না দিলে আমরা ইসলামের বিরোধিতা করবো। তারপর দেখা যাক, তাদের এই চিন্তা সমাজে কিভাবে প্লে-আউট করে।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সেক্যুলার গোষ্ঠীগুলো টিকে আছে ইসলামের প্রতি তাদের বিরোধিতা ও বিদ্বেষ গোপন করার মাধ্যমে। যদি তারা সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। এটা তারাও জানে। জানে বলেই, এই ধরণের সস্তা হাতসাফাই করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে।