ইতিহাসযুদ্ধসমসাময়িক

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। স্থানের নাম ঊম্মে দাফুক্ব, সাঊদার্ন দারফুর, রিপাবলিক অব সুদান।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। স্থানের নাম ঊম্মে দাফুক্ব, সাঊদার্ন দারফুর, রিপাবলিক অব সুদান।

দিনটা ছিল শুক্রবার। জুমার দিন। বিস্তীর্ণ চারণভূমি ও নিচু উপত্যকার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আলোচ্য দৃষ্টিনন্দন ভূখণ্ডকে সেদিন আচ্ছাদন করে রেখেছিল প্রশান্তিদায়ক নীরবতার অসাধারণ এক অনুভূতি। সাধারণত যে নীরবতা বা অনুভূতির দেখা পৃথিবীর এদিকটায় সহজে মেলে না।

দেখা না মেলার পেছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। পৃথিবীর বুকে অন্যতম সুদীর্ঘ সময় যাবত যেসব অঞ্চল যুদ্ধের বীভৎস আঘাত সয়ে চলেছে, সুদানের দারফুর তার মাঝে অন্যতম। এটি এমন এক ভূমি, যেখানে যন্ত্রণা ও প্রশান্তি, দু’য়ের পেছনের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে থাকে স্রেফ যুদ্ধ। ঊম্মে দাফুক্বের আজকের যে প্রশান্তিদায়ক নীরবতা, তার পেছনেও সে নিয়মের কোনো ব্যতয় ঘটেনি।

Central African Republic (CAR) ও সুদানের সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলটি এতদিন যাবত দখল করে রেখেছিল Rapid Support Forces (RSF) এর সেনারা। তবে স্থানীয় অধিবাসী ও যাযাবরদের মাঝে জাঞ্জাঊইদ নামে পরিচিতি পাওয়া বাহিনীটি কিছুদিন হলো এখান থেকে সরে গিয়েছে। ঊম্মে দাফুক্ব ও সীমান্তের অন্যান্য চৌকিতে মোতায়েন জাঞ্জাঊইদ বাহিনীর সরে পড়ার পেছনে যে কারণটি ভূমিকা রেখেছে, তার নাম আল ফাঁশির। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২,৩০০ ফিট উঁচুতে অবস্থিত আল ফাঁশির গর্বিত ভঙ্গিমায় বেয়াড়ার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দারফুরের মাটিতে সুদানিজ আর্মির সর্বশেষ ঘাঁটি হিসাবে দু’বছর ধরে সে দর্পের সাথে আপত্তি জানিয়ে চলছে জাঞ্জাঊইদ সেনাদের অনাচারে।

জেনারেল হামদান দাগালোর হাতে Rapid Support Forces (RSF) বলে পরিচিতি পাওয়া জাঞ্জাঊইদের বাহিনী অবশ্য সুদানে একলা লড়ছে না। সুদানের মাটিতে ওদের সাথ দিয়েছে রাশিয়া, আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের মতো প্রভাবশালী কিছু নাম। আর, ঠিক সেজন্যই সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে ঊম্মে দাফুক্বের স্নিগ্ধ হাওয়ায় দুলতে থাকা দৃষ্টিনন্দন তৃণভূমির প্রশান্তিদায়ক নীরবতা খান খান হতে চলেছে। কারণ, CAR এর সীমানা পেরিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে চারণভূমির মাঝে আবির্ভূত হতে চলেছে ফোর হুইলার, আর্মার্ড কার ও ডার্ট বাইকের একটি শক্তিশালী কনভয়। যে কনভয়ের সশস্ত্র আরোহীদের আগমন ঘটেছে সুদূর রাশিয়া হতে। পৃথিবীর মানুষের কাছে যাদের পরিচয় হলো PMC Wagner!

“মস্কোর চোখে আফ্রিকার সিংহদ্বার”

ওয়াগনারের সাথে সুদানের সর্বপ্রথম পরিচয় ২০১৭ সালে। ওয়াগনার তখন সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়ার হয়ে সংঘাত শেষ করেছে। কিন্তু, রাশিয়ার প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে টিকে থাকার উপযুক্ত কোনো স্থান মিলছে না তার। রাশান Ministry of Defence (MoD) ও ওদের নৃশংস গোয়েন্দা বাহিনী Main Directorate of the General Staff of the Armed Forces of the Russian Federation (GRU) অবশ্য ততদিনে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে রাশিয়ার এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে PMC Wagner এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। কিন্তু, তার জন্য যে কাঠামোর দরকার, তার লালন-পালন করার সামর্থ্য সেসময় ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার হয়ে দূর্বল হয়ে পড়া রাশিয়ার ছিল না। এমন অবস্থায় GRU এর শ্যেণদৃষ্টি আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে পড়ে।

মূল্যবান খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধ আফ্রিকার মাটিতে সোভিয়েত ইঊনিয়নের ভাঙনের পর কোনো রাশান পা রাখতে পারেনি। সুতরাং, GRU সেখানে পুনরায় ফিরে যাওয়ার আয়োজন শুরু করলো। পশ্চিমের খারাপ লুটেরাদের তাড়িয়ে পুবের ভদ্র লুটেরাদের আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার তোড়জোড় আরম্ভ করলো তারা। আর, ওদের সে পরিকল্পনার আলোচ্য অংশটিতে নিজের সমস্ত কার্যকারিতা নিয়ে হাজির হলো PMC Wagner।

২০১৭ সালের ২৩শে নভেম্বর তারিখে সুদানের স্বৈরশাসক ওমার আল-বশির রাশিয়ার মাটিতে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে অবস্থিত মনোরম গ্রীষ্মকালীন রিসোর্ট সিটি সোঁচিতে আয়োজিত সাক্ষাতটি যখন চলছে, তখন ওমার আল-বশির পুতিনের কাছে তাকে আমেরিকার হাত থেকে রক্ষার জন্য অনুরোধ করলেন। সুতরাং, পুতিন ও আল-বশিরের মাঝে অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। যার ফলে M Invest নামের একটি রুশ কোম্পানি সুদানের মাটিতে গোল্ড মাইনিং পরিচালনার অধিকার পেয়ে গেলো। আরেকটি সামরিক চুক্তির অধীনে রাশিয়া পেলো সুদানের নেভাল বেসে ৩০০ জন পার্সোনেল ও ০৪টি রণতরী মোতায়েনের বহু কাঙ্খিত অধিকার।

চুক্তি অনুসারে খনি হতে স্বর্ণ উত্তোলন করার অধিকার যারা পেলো, সেই M Invest ছিল আসলে PMC Wagner এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি কোম্পানি। আর ওদের হাতে স্বর্ণখনি তুলে দেওয়া ছিল আসলে রাশিয়ার হয়ে ওয়াগনার আল-বশিরকে যে সহায়তা করতে চলেছে, সুদানের পক্ষ হতে সে সহায়তার মূল্য পরিশোধ করার অভিনব উপায়।

মার্সেনারিদের সহায়তার বিনিময় তাদেরকে স্বর্ণখনির মালিকানা দিয়ে শোধ করার পদ্ধতিটি অবশ্য আধুনিক দুনিয়াতে একেবারে নতুন না। সাঊথ আফ্রিকার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি Executive Outcomes (EO) কে এর আগে অনুরূপ উপায়ে মূল্য পরিশোধ করেছিল আফ্রিকার বিভিন্ন স্বৈরশাসক। ফলে, ওয়াগনারের সুদানে স্বর্ণ উত্তোলনের অধিকার পাওয়ার পদ্ধতিটি EO Model হিসাবে পরিচিতি পায়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর মাস গড়াতে না গড়াতেই ‘১৭ সালের ডিসেম্বরে ওয়াগনারের মিলিটারি ইনস্ট্রাক্টরদের বহনকারী বিমান সুদানের মাটিতে অবতরণ করতে শুরু করে। শুরু হয় ওয়াগনারের উত্থান ও সুদানের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার নতুন অধ্যায়।

PMC Wagner আসলে কোন জাতের আন্তর্জাতিক সত্ত্বা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘকাল যাবত গবেষণা করেছেন। পরিশেষে তারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা হলো, ওয়াগনার আসলে প্রচলিত কোনো আন্তর্জাতিক কাঠামোর সাথে খাপ খায় না। তারা সরাসরি রাশিয়ার সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, আবার রাশিয়ার সরকারি কাঠামোর বাহিরেও নয়। ওয়াগনারের সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটি হলো, এটি একক কোনো কোম্পানি না। বরং ওয়াগনারের অধীনে অগণিত কোম্পানি পরিচালিত হয়। যারা GRU ও ওয়াগনার এর পক্ষ হতে ভিন্ন ভিন্ন এজেণ্ডা পূর্ণ করে। আর ওসমস্ত কোম্পানিকে ভুয়াও বলা সম্ভব হয় না। বরঞ্চ ওগুলো সত্যিকার অর্থে ওয়াগনারের হয়ে বেনামে নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পৃথিবীজুড়ে পরিচালনা করে বেড়ায়। যেমন সুদানের M Invest।

ওয়াগনার সুদানে আগমনের পর ওরা সুদানের মাটিতে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে মনোযোগ দিতে শুরু করে। আসলে ওদের সুদানের মাটিতে পা রাখার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল নিজেদের ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করা। সুতরাং, ওমার আল-বশির ওয়াগনারকে নিজের নিরাপত্তা ও প্রভাব বৃদ্ধির জন্য সুদানে নিয়ে আসলেও, ওয়াগনার সুদানে পা রাখার পর সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লো। ওরা আবিষ্কার করলো যে, আল-বশির আসলে ডুবন্ত জাহাজ। ফলে আল-বশির না থাকলে সুদানে ওরা কাকে দেখতে চায়, তার জন্য শুরু হয়ে গেলো ওদের বিকল্প সমাধানের তাৎক্ষণিক সন্ধান। ফলাফল হিসাবে দৃশ্যপটে আগমন হলো আমাদের পরিচিত একটি মুখের। যার নাম জেনারেল হামদান দাগালো।

Rapid Support Forces (RSF) বলে পরিচিতি পাওয়া জাঞ্জাঊইদের জেনারেল হামদান দাগালোর সাথে ওয়াগনারের পরিচিতির মাধ্যম ছিল স্বর্ণ। কারণ, জেনারেল দাগালোর জাঞ্জাঊইদ সেনারা তখন সুদানের অধিকাংশ স্বর্ণখনি নিয়ন্ত্রণ করতো। এতক্ষণে হয়তো আপনাদের মাঝে প্রশ্ন আসতে পারে যে, আমি ওদের জাঞ্জাঊইদ নামে কেন সম্বোধন করছি! আসলে জাঞ্জাঊইদ ছিল RSF এর পূর্বসূরী বাহিনীর পরিচয়। যে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল আরবি ভাষা থেকে। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় “ঘোড়ায় আরোহী শয়তান” কিংবা “অশুভ অশ্বারোহী”। যে মিলিশিয়া বাহিনী হতে RSF ও জেনারেল হামদান দাগালোর উৎপত্তি হয়, তারা নিজেদের অত্র অঞ্চলে জাঞ্জাঊইদ হিসাবে পরিচয় করিয়েছিল। তখন হতে স্থানীয়রা ওদের ও ওদের উত্তরসূরীদের আলোচ্য নামে ডেকে আসছেন।

ফিরে আসি মূল বিষয়ে। ওমার আল-বশিরের হাত ধরে তার সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আফ্রিকায় পা দেওয়া ওয়াগনার শেষপর্যন্ত তার সুরক্ষা ছাড়া বাকি সমস্ত কিছু সম্পন্ন করতে সমর্থ হলো। ওয়াগনার সুদানে পা রাখার মাত্র ১৫ মাসের মাথায় ওমার আল-বশির নিজ বাহিনীর সামরিক অভ্যূত্থানের ফলে ক্ষমতা হারালেন। যেখানে অভ্যূত্থানটি পরিচালনা করলেন সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল আহমাদ আ’ওয়ান বিন আউফ ও জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ বুরহান। জেনারেল হামদান দাগালো ও জাঞ্জাঊইদ তৎপরতাটি পরিচালনায় সেখানে নিজেদের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করলেন।

ততদিনে ওয়াগনার ঝড়ের গতিতে সুদান ছাড়াও আফ্রিকার আরো ০৩টি দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। সুদানের পর ওদের সে যাত্রার শুরু হয় পার্শ্ববর্তী দেশ CAR এর মাধ্যমে। তারপর একে একে ওয়াগনার হতে আগত রাশান কন্ট্রাক্টররা প্রথমে মাদাগাস্কার ও তারপর লিবিয়ার মাটিতে ঢুকে পড়ে। ওমার আল-বশিরকে যেদিন সুদানে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো, তার ০৭ দিন পূর্বে PMC Wagner লিবিয়ার উপকূলবর্তী শহর ত্রিপোলির ওপর Libyan National Army (LNA) ও ওদের নেতা কর্নেল খলিফা হাফতারকে সাথে নিয়ে অফেন্সিভ লঞ্চ করেছিল। যা ওমার আল-বশির ক্ষমতা হারাবার পর আরো ১৪ মাস চলমান থাকে। যাইহোক, মূল কথা হলো, ওমার আল-বশির ক্ষমতা হারালে ওয়াগনারের তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ, ততদিনে ওরা জেনারেল হামদান দাগালো ও তার Rapid Support Forces (RSF) কে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নিয়েছে। তার পাশাপাশি তখন পর্যন্ত ওরা সুদানের মূল সশস্ত্র বাহিনীকেও প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিল। ফলে, ওয়াগনারের জন্য সামনের পথ ছিল তখন পরিপূর্ণ মসৃণ।

ওয়াগনারকে রূশ সরকার আফ্রিকায় নিজেদের পলিসি বাস্তবায়নে পাঠালেও মস্কো হতে ওয়াগনারের ওপর কোনো বিধিনিষেধ বা সীমাবদ্ধতা দেওয়া হয়নি। সেখানে ওয়াগনারের স্বার্থই ছিল রাশিয়ার স্বার্থ। তার প্রমাণও মিলতে শুরু করেছিল। সুদান হতে উত্তোলিত স্বর্ণের কারণে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়ার ওপর আর কোনো প্রভাব খাটাতে সমর্থ হচ্ছিলো না। স্বর্ণের বড় একটি অংশ তখন রাশিয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণে জমা হচ্ছিলো, আর বাকি অংশ আফ্রিকা সহ দুনিয়ার আরো নানান প্রান্তে ওয়াগনারের কর্মকাণ্ড পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। ওয়াগনার রাতারাতি তখন রাশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিতে রূপলাভ করে।

আর, ওয়াগনারের কর্মকাণ্ড সেখানে শুধুমাত্র সামরিক তৎপরতা ও স্বর্ণ উত্তোলনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ওয়াগনারের তৎপরতা আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক তৎপরতার গণ্ডি পেরিয়ে ওখানকার দেশগুলোর কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঝেও আরম্ভ হয়ে যায়। ওয়াগনার আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে নিজের তথা রাশিয়ার জাল ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। যার অংশ হিসাবে ওরা মহাদেশটির বিভিন্ন দেশের মাঝে ও সীমান্ত অঞ্চলে ক্ল্যাণ্ডেস্টাইন সাপ্লাই রূট স্থাপন করে। দেশে দেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাশিয়ার অনুকূলে থাকা পক্ষগুলোকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশের সিংহাসনে থাকা ওয়াগনারের হয়ে কর্মরত ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদক্ষেপও ওরা নিতে শুরু করে।

সুতরাং, ওয়াগনার রাশিয়া থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের উপদেষ্টা হিসাবে আফ্রিকার দেশে দেশে নিয়োগ করতে থাকে। দেশগুলোর স্থানীয় প্রশাসনকে প্রশিক্ষণ ও আরো নানাবিধ সহায়তা দিয়ে সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব সংহত করতে থাকে। দরকার হলে রাশিয়া হতে বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞ সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদেরও সেখানে নিয়োগ করে তারা। নিজেদের পক্ষের রাজনৈতিক ও সামরিক নীতিনির্ধারকদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার স্বার্থে PMC Wagner পাশাপাশি ওসব দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাঝে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে Information Warfare চালাতে শুরু করে। তার সাথে, পশ্চিমাদের থেকে দূরে সরে রাশিয়ার বলয়ে চলে আসা আফ্রিকার ওসব নেতাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে PMC Wagner একটি Deterrence Factor ও ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এককথায়, সুদানের স্বর্ণকে বিনিয়োগ করে ওয়াগনার গোটা আফ্রিকা মহাদেশকে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে।

সুদানে নিজেদের অপারেশনের ফলাফল দেখে M Invest এর পর ওয়াগনার ওখানে আরো দু’টি কোম্পানি ডেপ্লয় করেছিল। M Finance ও Meroe Gold নামের কোম্পানি দু’টি তখন সুদানে স্বর্ণ উত্তোলন সহ নানাবিধ তৎপরতায় জড়িত হয়। এখন আমরা চলে যাচ্ছি একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে। যে দশকের শুরুতে রাশিয়া সমগ্র পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।

চলতি শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতে যখন আমরা পা রাখছি, ততদিনে PMC Wagner ক্ষুদ্র একটি Private Military Company হতে আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর PMC তে রূপান্তর লাভ করেছে। ওদিকে ওদের এসমস্ত সৌভাগ্যের পেছনে পার্থিব অবদান রাখা সুদানে তখন ঘোঁট পাকাচ্ছে শক্তিশালী ঘূর্ণি হাওয়া। ২০২০ সালে রাশিয়া সুদানের নতুন সরকারের সাথে পোর্ট সুদানে একটি শক্তিশালী নেভাল বেস স্থাপনের পক্ষে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সুতরাং, ‘২১ সালে সুদানে ঘাঁটি স্থাপনের পক্ষে জনমত তৈরির দায়িত্ব ওয়াগনারের ঘাড়ে গিয়ে পতিত হয়। অতএব, ২০২১ সালের পবিত্র রমজান মাসে PMC Wagner এর তৎকালীন দায়িত্বশীল Yevgeny Prigozhin সুদানের গরিব মানুষের মাঝে ১৯৮ টন খাদ্য ও আনুষঙ্গিক দরকারি সামগ্রী বিতরণ করার প্রকল্প আরম্ভ করে। সেসময় সুদানের অন্যান্য অংশে খাবারের নিদারুণ অভাব থাকলেও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ১০ টন খাবার সোজা তখন পোর্ট সুদানে পাঠানো হয়। এটি করার কারণ ছিল অত্র অঞ্চলে রাশিয়ার নাম উজ্জ্বল করা। যেন ওখানকার মানুষ শহরে রাশান নেভির ঘাঁটি স্থাপনের পক্ষে সম্মতি দিতে শুরু করে।

২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সালের কথা। সেদিন সুদানের সিংহভাগ স্বর্ণখনি ও Rapid Support Forces (RSF) এর নিয়ন্ত্রক জেনারেল হামদান দাগালো মস্কোর উদ্দেশ্যে সুদান থেকে বেরিয়ে পড়লো। সেদিন মস্কোর মাটিতে যখন তার বিমান অবতরণ করছে, ততক্ষণে ইঊক্রেনের ওপর শুরু হয়ে গিয়েছে রাশিয়ার আগ্রাসন। রাশিয়ার মাটিতে জেনারেল দাগালো সেবার ০৮টি দিন সফর করে। সেসময় তার সাথে একের পর এক শীর্ষপর্যায়ের রূশ নীতিনির্ধারকরা মিটিং চালাতে থাকেন। যেসব মিটিংয়ের ফলাফল পৃথিবী আবিষ্কার করে তার পরবর্তী বছর। যখন জানা যায় যে, PMC Wagner ইঊক্রেনে অভিযান শুরু হওয়ার পরের ১২ মাসে সুদানের বিভিন্ন খনি হতে ৩২.৭ মেট্রিক টন সোনা তুলে নিয়ে গিয়েছে! যে স্বর্ণের মূল্য কমপক্ষে ০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! যে মূল্যবান স্বর্ণের বিনিময়ে জাঞ্জাঊইদ সেনারা পেয়েছে ওয়াগনার থেকে ভারী ও হালকা অস্ত্র এবং রাশান কন্ট্রাক্টরদের হাতে আধুনিক সামরিক প্রশিক্ষণ।

রাশিয়া অবশ্য সুদানে প্রকাশ্যে দু’দিকেই সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। তবে, ওয়াগনারের হাত ধরে ওদের মূল তৎপরতা সেখানে আবর্তন করছে জেনারেল হামদান দাগালো ও তার জাঞ্জাঊইদ সেনাদেরকে ঘিরে। ২০২৪ সালে ইঊক্রেনিয়ান কমাণ্ডোরা সুদানে অভিযান চালিয়ে ওয়াগনারের ০৩ জন কন্ট্রাক্টরকে বন্দি করতে সমর্থ হয়েছিল। যাদের ওপর ইন্টারোগেশন চালিয়ে ইউক্রেনিয়ানরা সেবার ওয়াগনার RSF এর হয়ে সুদান সরকারকে উৎখাতের তৎপরতা চালাচ্ছে মর্মে স্বীকারোক্তি আদায় করতে সমর্থ হয়।

ওয়াগনার, বর্তমানে যারা অনেকটাই Africa Corps এর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে, ইসরায়েল ও আরব আমিরাতের সাথে আলোচ্য ভূখণ্ডে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কেন তৎপরতা পরিচালনা করছে, তার কারণ অনুধাবন করতে হলে আমাদেরকে সুদানের সীমান্ত পেরিয়ে বিস্তীর্ণ আফ্রিকা মহাদেশের ওপর আফ্রিকান ঈগলের ন্যায় শ্যেণ দৃষ্টি মেলে দৃষ্টিপাত করতে হবে। যেখান হতে আমরা ওদেরকে ভারত মহাসাগর থেকে নর্থ আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত একটি সুপরিচিত শক্তির সাথে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে দেখতে পাব। United Nations Designated Terrorist Organization জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন (JNIM) নামের যে বাহিনীটি বর্তমান সময়ে আফ্রিকা মহাদেশের ১১টি দেশের মাটিতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আর সোমালিয়া হতে উঠে আসা তাদের আরেকটি মিত্র সংগঠন বর্তমানে ভারত মহাসাগরের উপকূল হতে ০৩টি দেশের মাটিতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষ করে JNIM এর সাথে বর্তমানে PMC Wagner ও Africa Corps এর নিয়মিত ঘোরতর লড়াই হওয়াটা আফ্রিকার নিত্যদিনের ঘটনা। তারপর সুদানের বর্তমান গৃহযুদ্ধে আবার Rapid Support Forces (RSF) পরাজিত হয়ে গেলে সেখানেও অনুরূপ বাহিনী আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। সুদানের সামরিক বাহিনীর মাঝে কিছু ইসলামপন্থীর উপস্থিতির কারণে তাদের পরাজিত করা জরুরি শীর্ষক আলাপও আন্তর্জাতিক মহলে চলমান রয়েছে।

সুতরাং, জাঞ্জাঊইদ সেনাদের তাণ্ডব অতিশীঘ্র থেমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ, সভ্য দুনিয়ার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা ধরে রাখতে এবং আফ্রিকার সম্পদের প্রবাহ সভ্য দুনিয়ায় অব্যাহত রাখার জন্য আফ্রিকার মাটিতে জাঞ্জাঊইদদের দারুণ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় নাইজেরিয়া নিয়ে তোলপাড় আরম্ভ করেছে President Donald J. Trump। লেখার শুরু করেছিলাম ঊম্মে দাফুক্বে। সেখানেই শেষটা করে দিই।

PMC Wagner এর কনভয় সেদিন ঊম্মে দাফুক্বে ইন্টারফেয়ারেন্স অপারেশনের অংশ হিসাবে কমপক্ষে সাত জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। চতুর্দিকের জনপদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ চালিয়ে ওদের বহর সেদিন সুদানের সীমানা পেরিয়ে ৩৫ কিলোমিটার গভীরে ঢুকে যায়। তারপর হতে সুদানের অবস্থা কি হয়েছে, তা আশা করি আমার বলার দরকার নাই।

ধন্যবাদ।

ফেসবুক পোস্ট

Hi, I’m Revan M

self-proclaimed defence analyst. tracking conflict in SA, MENA & Eastern Europe. Muslim. Fairbanks, Alaska

Leave a Reply